শূন্য চাষে সার সুপারিশের ভিত্তিতে সরিষা উৎপাদনে আর্থিকভাবে লাভবান প্রযুক্তি ও সম্ভাবনা
ড. মো: আজিজুল হক১ ড. মো. আব্দুল মালেক২ কামরুন্নাহার৩ সোহেল রানা৪ বাবুল আকতার৫
চাহিদার তুলনায় বাংলাদেশে ভোজ্যতেলের মোট দেশজ উৎপাদন অনেক কম হওয়ায় প্রতি বছর ঘাটতি মোকাবিলায় বিদেশ হতে প্রচুর পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করে ভোজ্যতেল আমদানি করতে হয়। দেশে ভোজ্যতেলের প্রধান উৎস হলো সরিষা। তাই সরিষা উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে ভোজ্যতেলের চাহিদা মেটানো অপরিহার্য। বাংলাদেশে ধাননির্ভর রোপা আমন-পতিত- বোরো/আউশ শস্যবিন্যাসটি দেশে বিস্তীর্ণ এলাকায় প্রচলিত। স্বল্প জীবনকালসম্পন্ন আমন ধান কর্তন করার পরপরই উচ্চফলনশীল স্বল্প জীবনকালীন সরিষা জাত বিনাসরিষা-৪, বিনাসরিষা-৯ ও বিনাসরিষা-১০ প্রভৃতি আবাদের মাধ্যমে সরিষা উৎপাদন বৃদ্ধি করা যেতে পারে। এ জন্য সরিষা চাষাবাদ পদ্ধতিতে কিছু পরিবর্তন আনার প্রয়োজন। বর্তমান চাষাবাদ পদ্ধতিতে রোপা আমনের জমি ‘জো’ আসলে চাষ করে সরিষা আবাদ করা হয়। তাছাড়া জলবায়ুর পরিবর্তনে প্রতিকূল আবহাওয়ায় অনেক সময়ে সরিষা বপনকালীন উপযুক্ত সময় যেমন অক্টোবরের শেষ সপ্তাহ হতে নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহের মধ্যে আকস্মিক বৃষ্টিপাতের কারণে সরিষা বপনকাল বিলম্ব হয়ে যায় তখন কৃষক আর সরিষা বপনে আগ্রহ দেখায় না। শূন্য চাষে সরিষা আবাদের মাধ্যমে এ সমস্যা সমাধান করা যেতে পারে। শূন্য চাষে সরিষা আবাদের জন্যে জমিতে ‘জো’ আনার প্রয়োজন হয় না ফলে বীজ বপনে তুলনামূলক বিলম্ব হয় না। এ জন্য বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিনা) মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগ, বিভিন্ন এলাকায় মৃত্তিকায় বিদ্যমান পুষ্টি উপাদানের ভিত্তিতে গবেষণা পরিচালনা করে বিভিন্ন মাত্রায় প্রয়োজনমাফিক সুষম সার প্রয়োগের মাধ্যমে শূন্য চাষে সরিষা চাষাবাদের কলাকৌশল উদ্ভাবন করেছে।
চাষাবাদ পদ্ধতি
বীজ বপন : আমন ধান কর্তনের পরপরই জমিতে পর্যাপ্ত রস (৪৫-৫০% আর্দ্রতা) থাকা অবস্থায় (জমিতে চলাচল করলে পায়ের ছাপ পড়ে এমন আর্দ্রতায়) আমন ধানের সারির মাঝে সরিষা বীজ বিঘাপ্রতি ১.০ কেজি বপন করতে হবে। তবে সারি ছাড়াও ছিটিয়েও বপন করা যায়। যদি জমিতে পর্যাপ্ত রস না থাকে এবং বৃষ্টিপাতও না হয় সে ক্ষেত্রে বীজ বপনের একদিন পূর্বে একটি সেচ প্রয়োগ করে সরিষা বীজ বপন করতে হবে। অঞ্চলভেদে অক্টোবরের শেষ সপ্তাহ হতে ডিসেম্বরের ২য় সপ্তাহ পর্যন্ত শূন্য চাষে সরিষার বীজ বপন করা যায়।
সার প্রয়োগ : শূন্য চাষে সরিষা আবাদে প্রয়োজনমাফিক সময়মতো সুষম সার প্রয়োগ অত্যন্ত জরুরি। সরিষা বীজ বপনের আগেই ইউরিয়া ছাড়া টিএসপি, এমওপি, জিপসাম, দস্তা ও বোরন সার ছিটিয়ে প্রয়োগ করতে হবে। ইউরিয়া সার দুই কিস্তিতে প্রয়োগ করতে হবে। প্রথম কিস্তি অবশ্যই বীজ বপনের ১০ দিন পর এবং দ্বিতীয় কিস্তি বীজ বপনের ২৫-৩০ দিন পর প্রয়োগ করতে হবে। সারণি -১ এ মৃত্তিকায় বিদ্যমান পুষ্টিমানের ভিত্তিতে প্রয়োগকৃত সারের মাত্রা ও পরিমাণ প্রদান করা হল।
সেচ ও নিষ্কাশন : জমিতে পর্যাপ্ত রস না থাকলে প্রয়োজনমত সেচ প্রয়োগ করতে হবে। বীজ গজানোর পরে প্রয়োজনে ২০-২৫ দিনের মাঝে একবার এবং ৪০-৪৫ দিনের মাঝে দ্বিতীয়বার সেচ প্রয়োগ করতে হবে। বৃষ্টিপাত হলে সেচের প্রয়োজন নেই। তবে এঁটেল মাটির ক্ষেত্রে জমিতে রস কমে গেলে বা শুকিয়ে গেলে জমি শক্ত হয়ে যেতে পারে সে ক্ষেত্রে উপরের নিয়মে অবশ্যই প্রথম সেচ প্রদান করতে হবে। অতিরিক্ত সেচের পানি বা বৃষ্টির পানি যেন জমি থেকে বের হয়ে যেতে পারে এ জন্য নালার মাধ্যমে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা রাখতে হবে।
আগাছা দমন ও পাতলাকরণ : আগাছার উপদ্রব হলে চারা গজানোর ১৫-২০ দিনের মধ্যে নিড়ানি দিয়ে আগাছা দমন করতে হবে। চারা বেশি ঘন হলে প্রয়োজনমাফিক পাতলা করে দিতে হবে।
রোগ ও পোকামাকড় দমন : ছত্রাক ঘটিত অল্টারনারিয়া ব্লাইট রোগ সরিষা ফসলে ব্যাপক ক্ষতি করে। এ রোগ দেখা মাত্র রোভরাল-৫০ ঢ়ি ০.২% হারে (প্রতি লি. পানির সাথে ২ গ্রাম) পানিতে মিশিয়ে গাছে স্প্রে করতে হবে। সরিষা ফসলের প্রধান শত্রু জাবপোকার আক্রমণ দেখা যাওয়ার সাথে সাথে ম্যালাথিয়ন ৫৭ ঊঈ প্রতি লি. পানির সাথে ২ মিলি. মিশিয়ে স্প্রে করা যেতে পারে। তবে সরিষা ক্ষেতে মৌমাছির আনাগোনার সময়ে কীটনাশক প্রয়োগ করা ঠিক নয়।
প্রযুক্তির উপযোগিতা : রোপা আমন পরবর্তী এবং আগাম পানি নেমে যায় এমন হাওর, বিল ও চর এলকার জমিসহ অন্যান্য সরিষা চাষযোগ্য জমির জন্য প্রযুক্তিটি বেশ উপযোগী।
ফলাফল : বিনার মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগ, বিনা উপকেন্দ্র, ঈশ্বরদী, পাবনা ও কৃষকের জমি অরোণকোলা, ঈশ্বরদীতে এবং বিনা উপকেন্দ্র বরিশালে এবং কৃষকের জমি বাবুগঞ্জ, বরিশালে শূন্য চাষে সরিষায় মৃত্তিকায় বিদ্যমান পুষ্টি উপাদানের ভিত্তিতে বিভিন্ন মাত্রায় সার প্রয়োগের উপর গবেষণা পরিচালনা করে। এতে দেখা যায় বিনা সরিষা-৯ আবাদে ঈশ্বরদীতে ১০০% মাত্রায় (প্রতি হেক্টরে ইউরিয়া ২৪২, টিএসপি ১০৫, এমওপি ১২৬, জিপসাম ১০৭, বোরোনের জন্য বোরিক এসিড ১২ এবং দস্তার জন্য জিংক সালফেট হেপ্টা ৬ কেজি করে) সার প্রয়োগে লাভজনক (১.৫৮ ট/হে সরিষা) ফলন পাওয়া যায় এবং বরিশালে বিনা সরিষা-৯ আবাদে ১২৫% মাত্রায় (প্রতি হেক্টরে ইউরিয়া ৩০২, টিএসপি ১৩১, এমওপি ১৫৮, জিপসাম ১৩৩, বোরোন ১২ এবং দস্তার জন্য জিংক সালফেট হেপ্টা ৬ কেজি করে) সার প্রয়োগে লাভজনক (১.৫৪ ট/হে সরিষা) ফলন পাওয়া যায় সারণি-১, ২, ৩ দ্রষ্টব্য।
প্রযুক্তিটির সুবিধা/লাভ : উপরোক্ত নিয়মে শূন্য চাষে সরিষা আবাদে বরিশাল ও ঈশ্বরদী এলাকায় ৬০,১৩৩/- হতে ৭৭,৬১৯/- টাকা লাভ হয় যাতে আয়-ব্যয় অনুপাত দাঁড়ায় যথাক্রমে ২.১৭ ও ২.৮০। তাছাড়াও প্রযুক্তিটির প্রয়োগ-প্রসারে রোপা আমন পরবর্তী অধিক পরিমাণ পতিত জমি সরিষা আবাদের আওতায় আসবে এবং দেশে সরিষার উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। এ পদ্ধতিতে সরিষা চাষে কর্ষণজনিত সময় ও খরচ সাশ্রয় হয় এবং বীজ বপনেও বিলম্ব হয় না ফলে কৃষক আর্থিকভাবে লাভবান হয়। প্রতিকূল জলবায়ুতে অতি বৃষ্টিজনিত ক্ষতি হলে পুনরায় বপন করেও আশানুরূপ ফলন পাওয়া যায়। প্রযুক্তিটি সরিষার উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে পুষ্টি নিরাপত্তায় ও সরকারের টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট অর্জনেও অবদান রাখবে।
সারণি-১: বিভিন্ন এলাকায় শূন্য চাষে সরিষা আবাদে প্রয়োগকৃত সারের মাত্রা ও পরিমাণ।
সারণি -২: শূন্য চাষে বিভিন্ন মাত্রায় সার প্রয়োগে সরিষা ও খড়ের গড় ফলন (ট/হে)
সারণি-৩: শূন্য চাষে সরিষায় বিভিন্ন মাত্রায় সার প্রয়োগে (বিনা সরিষা-৯) আয়-ব্যয় ও লাভ (টাকা)
দ্রষ্টব্য: সার, বীজ, সেচ, রোগ ও কীটনাশক এবং শ্রমিকজনিত ব্যয় মোট ব্যয়ের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সরিষা ও খড়ের মূল্য মোট আয়ের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
লেখক : ১সিএসও ২পরিচালক (গবেষণা) ৩-৪এসও ৫এসএসও, বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাকৃবি ক্যাম্পাস, ময়মনসিংহ। মোবাইলঃ ০১৭১৬৬২৭৩০৩ ই-মেইল : azizul_bina@yahoo.com